
‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। অপেক্ষার অনেক বছর পেরিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতিমালাটির আলোর মুখ দেখাতে পেরেছে। এ জন্য তারা সাধুবাদ পেতে পারে। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীবান্ধব।
Advertise
বিগত ১১ বছরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানগত দিক দিয়ে এ দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এখন অনেকাংশে অগ্রসরমাণ। এর পেছনের মূল কারণ বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দুটি যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, একই সঙ্গে একীভূত, সমন্বিত ও বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, প্রতি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ কার্যক্রম, চাকরির ক্ষেত্রে বয়স ও কোটা প্রবর্তন, বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কিছুসংখ্যক বিশেষায়িত স্কুলকে বেতন-ভাতা বাবদ থোক বরাদ্দ প্রদান।
Advertise
সর্বোপরি প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রচার ও প্রচারণা। গৃহীত প্রতিটি কার্যক্রমে সরকারপ্রধান ও তাঁর সুযোগ্য কন্যার সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। সরকারকে ধন্যবাদ আরো এই জন্য যে এগুলো সরকারের খণ্ডকালীন নয়, বরং প্রতিটি উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় খুব সুনির্দিষ্টভাবে অনগ্রসর প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি স্থান পেয়েছে।
Advertise
বর্তমান সরকারের সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও যুক্তিসংগত উদ্যোগ হলো প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে কমপক্ষে একটি করে একীভূত শিক্ষার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বিশেষায়িত স্কুল স্থাপনে উৎসাহ ও স্বীকৃতি প্রদান এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে এ স্কুলগুলো এক পর্যায়ে এমপিওভুক্তকরণ। সব ধরনের শিশুর শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষাজীবন নিশ্চিতকরণে বিদ্যমান শিক্ষা পরিস্থিতিতে এর কোনো বিকল্প পথ আমাদের জানা নেই।
বিশেষায়িত শিক্ষার তিনটি মূল উদ্দেশ্য।
এক.
যেসব প্রতিবন্ধী শিশু (মাঝারি ও চরম মাত্রার) বিশেষত এনডিডি অর্থাৎ অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন্স সিনড্রোম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত, তাদের জীবন দক্ষতার পাশাপাশি নমনীয়ভাবে মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা;
দুই.
যেসব শিশুর পক্ষে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূলধারায় যাওয়া সম্ভব নয়, তাদের আগ্রহ ও সক্ষমতার ভিত্তিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, যাতে পরিবারের বোঝা না হয়ে নিজের জীবন নিজেই পরিচালনা করতে পারে এবং
তিন.
যেসব শিশু চরম ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতার শিকার, তাদের সামাজিক জীবন নিশ্চিতকরণে দৈনন্দিন জীবন কার্যাবলি (ডিলএ) শিক্ষা প্রদান করা। কিন্তু সরকার এ উদ্দেশ্য অর্জনে যে বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা চূড়ান্তকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তা অর্জনে সহায়ক নয়, বরং অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করবে। প্রকাশিত নীতিমালায় প্রতি জেলায় একটি করে এনডিডি স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে;
যদিও বিগত ১০ বছরে ‘সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০০৯’-এর আলোকে দেশে এক হাজারেরও বেশি বিশেষায়িত বিদ্যালয় এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে। পাঁচ থেকে আট বছর ধরে এসব স্কুলে কমপক্ষে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার প্রতিবন্ধী শিশু পড়াশোনা করেছে এবং যার মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি প্রতিবন্ধী শিশু কোনো দিন সাধারণ স্কুলে যায়নি। এসব স্কুল প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত হওয়ার কারণে প্রতিবন্ধী শিশুরাও লেখাপড়া করতে পারে, জীবনে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। প্রতি জেলায় একটি করে স্কুল হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলমুখী প্রতিবন্ধী শিশুদের বৃহৎ একটি অংশ আবার শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
ডিস-এবিলিটি অ্যালায়েন্স অন এসডিজির বেইসলাইন সার্ভের মধ্যেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে। সার্ভে প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষা নীতিমালা ২০১০-এর বাস্তবায়নের কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুরাও পড়াশোনার ক্ষেত্রে স্বাছন্দ্য বোধ করছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে একটি নির্দিষ্ট অংশ, বিশেষত এনডিডি শিশুরা সাধারণ স্কুলে টিকে থাকতে না পেরে আবার সমন্বিত, না হয় বিশেষায়িত, না হয় স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত স্কুলগুলো ঝরে পড়া রোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিগত দিনে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত স্কুলগুলোর মধ্যে সরকার অল্পসংখ্যক স্কুলকে বেতন-ভাতা প্রদান করছে। কিছুসংখ্যক স্কুলকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং অনেক স্কুলের স্বীকৃতি প্রদানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অডিট করিয়ে প্রতিবেদন জমা নিয়েছে। আবার কিছু স্কুল রয়েছে, যেগুলোর কোনো অডিট হয়নি। প্রতি জেলায় মাত্র একটি বিদ্যালয় সরকারি সুবিধার আওতায় এলে বাকি স্কুলগুলোতে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী শিশুদের কী হবে? এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী হবে? সরকারকে এ বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯ চূড়ান্তকরণের আগে নীতিনির্ধারকরা নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাগুলো ভেবে দেখতে পারেন। এক. স্কুল কোথায় স্থাপিত হবে, তা নির্ধারণের মূল মানদণ্ড হবে প্রতিবন্ধী শিশু, বিশেষত অটিজমসহ এনডিডি শিশুর আধিক্য কোথায় তার ওপর। এ ক্ষেত্রে জেলা বা উপজেলা মুখ্য বিষয় নয়। দুই. প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবতার আলোকে প্রতি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে এনডিডিসহ অন্য প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষায়িত স্কুলের স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তকরণের উদ্যোগ গ্রহণ। তিন. এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোর মধ্যে অনুদানপ্রাপ্ত, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং সরকার কর্তৃক অডিট সম্পন্নকারী স্কুলগুলো কী প্রক্রিয়ায় সামনে অগ্রসর হবে, তা প্রকাশিত নীতিমালায় স্পষ্টকরণ। চার. প্রতিবন্ধী শিশুর উপযোগী শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণে স্বীকৃতি প্রদানের পর সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হোক এবং পাঁচ. বিদ্যালয় স্থাপনে অটিজমসহ এনডিডি শিশুর ন্যূনতম সংখ্যা ৫০ এবং এনডিডি ব্যতীত শিশুর ন্যূনতম সংখ্যা ৭৫ নির্ধারণ করা। আমরা চাই আর যেন কোনো প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়।
লেখক : প্রশিক্ষক ও লেখক
ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া
১। সহায়তা প্রাপ্ত প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমূহের তালিকা।
ডাউনলোড
২। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯।
ডাউনলোড
৩। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৯।
ডাউনলোড
Advertise